![]() |
ইসলামে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা |
ইসলামে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
আল্লাহ তায়ালা বলেন: 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা: নাহল, আয়াত:-৯০) যে সময় আল্লাহ তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য রাসুল (সা.)-কে পাঠিয়েছিলেন তখন সমাজে ন্যায়বিচার বলে কিছু ছিল না। সে তার সবকিছু লুটপাট করছিল। মানবতা ও ন্যায়বিচার ছিল নির্বাসনে।
আল্লাহ তায়ালা প্রিয় নবীকে সেই অন্ধকার যুগে বিশ্ববাসীর জন্য আলোকস্বরূপ পাঠিয়েছেন। তিনি সমাজে শান্তি, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। ন্যায়ের মাধ্যমে তিনি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ে আশার সঞ্চার করেন। কারণ ন্যায়বিচারহীন সমাজ কখনোই উন্নতি করতে পারে না। এ কারণেই প্রিয় নবী (সা.) সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মিশনের ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। তাঁর মিশনের উদ্দেশ্য ছিল ইহকাল ও পরকালে মুক্তি। মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তিনি আরও উপলব্ধি করেছিলেন যে ন্যায়বিচার একটি সর্বজনীন নীতি, যার প্রয়োগ একটি সুস্থ সমাজ সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য।
যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, ২৩ বছরের আজীবন প্রচেষ্টার পরে তিনি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন। তাঁর উপস্থাপিত জীবন ব্যবস্থা মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে ন্যায় ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিয়ন্ত্রক ও চালিকাশক্তি। এই গুণের কারণেই মানুষের মর্যাদা এবং পারস্পরিক দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। নিজের অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি সমাজের অন্য সদস্যদের অধিকার জানা জরুরি, যাতে কেউ নিপীড়িত না হয়।
স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব এড়িয়ে চলুন
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, নবী (সা.) কখনোই তার গোত্রের লোকদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা স্বজনপ্রীতি প্রদর্শন করেননি; বরঞ্চ তিনি তার কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিটি মোড়ে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ মাখজুম গোত্রের একজন চোরের ঘটনা কুরাইশদের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের খুব কষ্ট দিয়েছিল। এমতাবস্থায় তারা কথা বলতে থাকে কে এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে কথা বলতে পারে। তারা বলেন, এ ব্যাপারে সুপারিশ করার সাহস একমাত্র মহানবী (সা.)-এর প্রিয়তম ওসামা বিন জায়েদ (রা.)ই করতে পারেন। সবাই মিলে শাফায়াতের জন্য ওসামাকে (রাঃ) চিহ্নিত করলেন। ওসামা রাসুল (সাঃ) এর সাথে কথা বললেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন: "তুমি কি সীমালঙ্ঘনকারীর শাস্তি স্থগিত করার সুপারিশ করছ?" অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উঠে দাঁড়ালেন এবং খুতবায় বললেন, "তোমাদের পূর্বের লোকেরা এই কাজটি ধ্বংস করেছিল যে, তাদের মধ্যে কোন বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি চুরি করলে তারা তাকে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দিত।" অন্যদিকে, একজন দরিদ্র ও অসহায় সাধারণ মানুষ চুরি করলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা চুরি করত; তাহলে সে অবশ্যই তার হাত কেটে ফেলবে (ফৌজদারি কোড অনুসারে)। (সহীহ বুখারী, হাদিস :-৩৪৭)
অমুসলিমদের মধ্যে ন্যায়বিচার
ন্যায় ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা প্রিয় নবী (সা.) অমুসলিমদের মধ্যে সমানভাবে বাস্তবায়িত করেছিলেন। এই ক্ষেত্রে, তার প্রিয় সঙ্গী এবং অন্য ইহুদী হওয়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি; পরিবর্তে, তিনি তার নিজস্ব নীতি অনুসারে উভয়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য মিথ্যা শপথ করে, সে এমন অবস্থায় আল্লাহর দরবারে হাজির হবে যে, আল্লাহ। রাগ হবে। (সহীহ বুখারী, হাদিস: ২৪১৬)
সোরাকা নামক এক ব্যক্তি বেদুঈনের কাছ থেকে একটি উট ক্রয় করে মূল্য পরিশোধ না করায় বেদুইন তা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দরবারে নিয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রশ্নের জবাবে সোরাকা বললেন, তার মূল্য পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বেদুইনদের বললেন, "এটি বাজারে বিক্রি করে তোমার ঋণ আদায় কর।" বেদুইন তাই করল।
ন্যায়পরায়ণদের জন্য সম্মানের আসন
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে বিচার দিবসে বিচারের প্রতিদান কী হবে? তাদের এই অনন্য পুরস্কারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রিয় নবী (সা.) সাহাবাদের হৃদয়ে ন্যায়ের বীজ বপন করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ বিচারকরা (বিচারের দিন) আলোর মিম্বরে দয়াময়, পরম করুণাময় আল্লাহর ডান হাতে বসবেন। আল্লাহর সাথে। তার উভয় হাত ডান হাত (অর্থাৎ সমান বড়)। যারা তাদের স্বজনদের প্রতি ন্যায়বিচার করে এবং তাদের সরকারে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব। (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৪৬১৫)
সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ
তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি যে সমাজ ও রাষ্ট্র শাসন করেছেন সেখানে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তিনি কতটা সতর্ক ছিলেন, উপরোক্ত ঘটনা তার স্পষ্ট প্রমাণ। অশুভ দমন, শালীনতা পালন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ন্যায় বিচার বিভাগ অপরিহার্য পূর্বশর্ত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি ইজতিহাদ দ্বারা বিচার করে এবং যদি তার ইজতিহাদ সঠিক হয় তবে তার জন্য দুটি সওয়াব রয়েছে। আর ইজতিহাদে ভুল হলে সওয়াব আছে। বিচারক তিন প্রকার। জাহান্নাম দুই প্রকার এবং জান্নাত এক প্রকার। যে ব্যক্তি সত্য জেনে বিচার করবে সে জান্নাতে আছে। যে অজ্ঞতাবশত বিচার করে সে জাহান্নামী এবং যে বিচারে অন্যায় সেও জাহান্নামী। (ইবনে মাজাহ, পৃ. ৩৪১-৩৪২)
সামাজিক জীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠা
রাসুলুল্লাহ (সা.) সামাজিক জীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কিছু বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত, তিনি সম্পদ অর্জন, সঞ্চয় এবং ব্যয়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলেন। সমসাময়িক বিশ্বে, বিশেষ করে প্রাক-ইসলামী সমাজে সম্পদ ছিল আভিজাত্যের মাপকাঠি, সাফল্যের নিদর্শন, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। তাই মানুষ সারাজীবন অর্থ ও সম্পদের পেছনে ছুটছে। বৈধ-অবৈধ, হালাল-হারাম, ন্যায়-নীতি, পাপ-পুণ্য- এগুলো প্রদান করা হয় না। এভাবে মানুষ সম্পদের দাস হয়ে গেছে এবং সম্পদ তাদের প্রভু হয়েছে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য তিনি যে দর্শন পেশ করেছেন তা হলো, মানুষের জীবনে অর্থ অপরিহার্য। জীবন ও জীবিকার তাগিদে সম্পদ অর্জন ও ব্যবহার করতে হবে; কিন্তু এটাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। অর্থ-সম্পদসহ পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের সেবক ও সেবক। পৃথিবীর উপাদান মানুষের জন্য তৈরি করা হয়েছে। (সূরা বাকারা :- ২৯)
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নীতি ও নিয়মানুযায়ী সম্পদ
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে নীতি ও নিয়মানুযায়ী সম্পদ অর্জন করতে এবং যাকাত ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের একটি অংশ গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশ দেন। এছাড়াও রাসুলুল্লাহ (সা.) রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পদে জনগণের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য ছয় ধরনের রাজস্ব চালু করেছিলেন।
এগুলো হলো- ১. আল-ঘনিমাহ বা যুদ্ধের গনীমত,
২. যাকাত,
৩. অমুসলিম কৃষকদের জমির উপর খারাজ বা কর,
৪. অমুসলিমদের উপর জিজিয়া বা নিরাপত্তা কর,
৫. আল-ফাই বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি,
৬. দাতব্য অথবা স্বেচ্ছায় দান।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তুলেছিলেন। বংশ ও আভিজাত্যের গৌরবের চেয়ে মানবতার ভিত্তিতে তিনি সমাজের বন্ধনকে মজবুত করেছেন। তিনি কোন অনিশ্চিত শর্তে বলেছেন: 'আরবের উপর কোন আরব, অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সকল পুরুষ একে অপরের ভাই। সকল মানুষ আদমের বংশধর এবং আদম মাটির তৈরি। (মুসনাদে আহমাদ: খ. ২, পৃ.- ৩৩)
✍️ কুরআন সুন্নাহ ✍️